মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব বা আশরাফুল মাখলুকাত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অবশ্যই আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে।’ (সুরা তিন, আয়াত :৪) আল্লাহ তা’লার সৃষ্টির মধ্যে মানুষের থেকে সুন্দর আর কেউ নেই। তাঁর সৃষ্টিতে নেই কিঞ্চিত ত্রুটি। সবকিছু যেন পরিপূর্ণ। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য স্বাভাবিকের ভীড়ে কিছু মানুষকে চাহিদাসম্পন্ন করে পৃথিবীতে পাঠান। যাঁরা সমাজের অন্যান্যদের থেকে একটু ভিন্ন। কেউ কানে শুনে না, কেউ চোখে দেখে না, কারো বুদ্ধি কম, কেউ কেউ আবার শারিরীক অক্ষম। একজন মানুষ কখনো শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় না। কোনো না কোনো সমস্যা তাঁর থাকবেই। এমন সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিকে বলা হয়, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি। যাঁদের সমাজ প্রতিবন্ধী বলে জানে। আসলে অন্তর্দৃষ্টি ভাবনায় তাঁরা প্রতিবন্ধী নয়, তাঁরা আমাদের ‘প্রতিবন্ধু’। পরিবার তথা সমাজের কাছে তাঁদের বোঝা মনে হয়। ওরা বোঝা নয়, বরং সম্পদ। অক্ষম এই মানুষ গুলোর প্রয়োজন সঠিক যত্ন ও স্নেহ-ভালোবাসা। অনেক সময় কিছু কিছু অক্ষম মানুষকে বাড়তি সেবা করে কিছুটা সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয়ে উঠে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে এখন মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৮ শতাংশ প্রতিবন্ধী। সর্বশেষ জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ। এর মধ্যে ২ দশমিক ৮ শতাংশ হিসাব করলে ৪৬ লাখ প্রতিবন্ধী, যাঁদের অন্তত এক ধরনের প্রতিবন্ধিতা রয়েছে। ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন অনুযায়ী, মোট ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতা রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধিতা শারীরিক, এ হার ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

এরপর আছে যথাক্রমে দৃষ্টি, শ্রবণ ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা। মাঠপর্যায়ে একটি জরিপ বলছে, প্রতিবন্ধিতার কারণ বেশিভাগ জন্মগত সমস্যা ও অসুস্থতা। এছাড়াও গাছ বা ছাদ থেকে পড়ে অথবা দুর্ঘটনায় শারিরীক অক্ষম হলে তাঁরাও প্রতিবন্ধী। তবে বয়সভিত্তিক প্রতিবন্ধিতার হিসাবে দেখা যায়, ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে এ হার তুলনামুলক বেশি। জরিপে আরো দেখা যায়, তিন বছর বা এর বেশি বয়সের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ৫৫ শতাংশের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। প্রতিবন্ধিতার কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তুলনায় তাঁরা বিলম্বে পড়াশোনা শুরু করে। ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী শিশুদের ৩৫ শতাংশ প্রাথমিক স্তরে ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৪৯ শতাংশ মাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি ৩ জনে ১ জন কর্মে নিয়োজিত। যাঁদের অধিকাংশই আত্মকর্মসংস্থানে যুক্ত। নিবন্ধন রয়েছে, এমন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে ভাতা পাচ্ছেন ৯১ শতাংশ।

তবে সমাজে এমনও দেখা মিলে, সুস্থ সবল মানুষ হয়েও সামান্য সরকারি ভাতা সুবিধার জন্য নিজেকে প্রতিবন্ধীতে অন্তর্ভুক্ত করে। আবার অনেক শিক্ষার্থী আছেন যাঁরা প্রতিবন্ধী কোটা সুবিধার জন্য নিজেকে প্রতিবন্ধী হিসেবে তালিকাভুক্ত করছে। এসব কাজ সমাজ ও দেশের জন্য চরম বিপর্যয় এবং রাষ্ট্রীয় অপরাধ। বাংলাদেশ সরকার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এব মানুষের জন্য মাসিক ভাতা, কর্মক্ষেত্রে অগ্রাধিকার, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, প্রতিবন্ধী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ সহ তাঁদের চলাচলের জন্য হুইল চেয়ারের সুযোগ করে দিচ্ছেন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, সেচ্ছাসেবী ও উন্নয়নমূলক সংগঠনও এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে তাঁদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের সমাজে এসব প্রতিবন্ধুদের দিকে একটু নজর দিলে দেখা যায়, তাঁরা খুবই পরোপকারী, সহজ-সরল ও সত্যবাদী। তাঁদের অন্তরে নেই কোনো হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার। এছাড়াও এদের মেধা অনেক তীক্ষ্ণ। একবার কারো নাম শুনলে বা নির্দিষ্ট কোনো কাজে তাঁদের অভাবনীয় সাফল্য দেখা যায়।

এছাড়াও অনেক চাহিদাসম্পন্ন মানুষ আছেন যাঁরা ভিক্ষাবৃত্তি পথ বেছে নেয় না। নিজেই কোন না কোন ব্যবসা বা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উপার্জন করেন। এভাবেই বহু মানুষ তাঁদের পরিবার, পরিজন পরিচালিত করছেন। তাই সকলের মনে রাখা উচিত, প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, বরং অমূল্য সম্পদ। কারণ, তাঁদের মধ্যে রয়েছে আল্লাহ প্রদত্ত তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন অনন্য প্রতিভা। এসব প্রতিবন্ধিতা অক্ষমতা নয়, এক ভিন্ন ধরনের সক্ষমতা। সুযোগ পেলে প্রতিবন্ধীরাও দক্ষতা ও পারদর্শিতার মাধ্যমে অনেক কিছু করতে পারে। প্রতিবন্ধীদের মেধা ও প্রতিভাকে কাজে লাগাতে পারলে তাঁরা দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত হবে। তাই আসুন, প্রতিবন্ধীদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও সহমর্মিতা প্রকাশে যত্নবান হই । তাঁদের প্রতি যে যার অবস্থান থেকে ভালোবাসা দেখাই। তাঁদের মধ্যে যেন কোনো বৈষম্য না করি। তাঁরা আমাদের সন্তান, ভাই, বোন বা নিকট আত্মীয়। আসুন, তাঁদের প্রতিবন্ধী না, প্রতিবন্ধু বলি। লেখক: জি.বি.এম রুবেল আহম্মেদ সম্পাদক খরকা নিউজ